আবৃত্তির ক্যানভাস ও কাব্য নান্দনিকতা - হৃদয় লোহানী

 


আবৃত্তির ক্যানভাস ও কাব্য নান্দনিকতা - হৃদয় লোহানী
আবৃত্তির ক্যানভাস ও কাব্য নান্দনিকতা 
-হৃদয় লোহানী  

আবৃত্তি একটি প্রতিষ্ঠিত বাচিক শিল্প যা কবিতা, গদ্য বা অন্য লেখা শ্রোতার সম্মুখে পরিবেশন করার মাধ্যমে আবেগ এবং ভাবনার প্রকাশ করে। এটি সাধারণত বিশেষ অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়। আবৃত্তি কেবল একটি শিল্প নয়, বরং এটি মানবিক অনুভূতির প্রকাশ এবং সাহিত্যাঙ্গনে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সামগ্রিক রূপকে কণ্ঠস্বরে যথাযথ প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রমিত উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রেখে বিষয়ে ধারণকৃত অনুভূতি, আবেগ, ভাব, গতি, বিরাম, ছন্দ ইত্যাদির সমন্বিত ও ব্যঞ্জনার প্রকাশই আবৃত্তি। 

কবির কাজ যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই আবৃত্তিকারের দায়িত্ব শুরু হয়। আবৃত্তিকারের কাজ কবিতাকে রূপ-রং-রসে পূর্ণ করে অধিক গ্রহণের উপযোগী করে তোলা। সাধারণের কাছে কবিতাকে অধিক জনপ্রিয় করে তোলার দায়িত্ব আবৃত্তিকার নিজেই তার কাঁধে তুলে নেন। এ দায়িত্ব কেউ তাকে নিতে বলেন না। আবৃত্তি বর্তমানে এক জনপ্রিয় শিল্পের নাম। আবৃত্তির চর্চা গ্রাম থেকে শহরে,বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে,ইলেকট্রনিক সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে দিন দিন বেড়েই চলেছে। কবিতাকে লোকপ্রিয় করার ক্ষেত্রে আবৃত্তির অবদান অনঃস্বীকার্য। অনেকে ভাবেন,গলার স্বর জোরালো হলে, কন্ঠস্বর ইচ্ছামত ওঠানো- নামানো গেলেই ভাল আবৃত্তিকার হওয়া যায়।  আবৃত্তি চর্চা আমাদের কবিতাকে ভালোবাসতে শেখায়, আমাদের নান্দনিক আনন্দ দান করে,আমাদের বাচনভঙ্গি সুন্দর করে,আমাদের কথাকে সুন্দর করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। আবৃত্তি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। 

আবৃত্তি (ইংরেজি: Recitation) সাধারণ ধারণায় শ্রোতার সম্মুখে কোনো কবিতা বা বক্তব্য ইত্যাদি আকর্ষনীয়ভঙ্গিতে উপস্থাপন করার একটি শিল্প। সাহিত্য পদবাচ্যের (কবিতা এবং গদ্য) সামগ্রিক রূপকে কণ্ঠস্বরে যথাযথ প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রমিত উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রেখে বিষয়ে ধারণকৃত অনুভূতি, আবেগ, ভাব, গতি, বিরাম, ছন্দ ইত্যাদির সমন্বিত ও ব্যঞ্জনার প্রকাশই আবৃত্তি।

দুই ধরনের আবৃত্তি প্রচলিত রয়েছে- ১ আবৃত্তি অনুষ্ঠান ২ আবৃত্তি প্রযোজনা উল্লেখিত দুটি ধরনের মধ্যে আবৃত্তি প্রযোজনা কে অধিকতর শিল্প সম্ভাবনাময় মনে করা হয়। আবৃত্তির উপাদান, বিষয়বস্তু (কবিতা, গল্প, গল্পাংশ, সাহিত্য মান সমৃদ্ধ চিঠি, প্রবন্ধ, নাট্যাংশ, বিখ্যাত কোন ভাষণ ইত্যাদি)

আবৃত্তি ও পাঠ অনেকর কাছেই দিন আর রাতের মতো । একটি দিন যেমন নতুন দিনের সূচনা করে ঠিক তেমনি ভাবে একটি রাতের শেষ ও নতুন ভোরের সূচনা দেয়।রূপ আলাদা হলেও উদ্দেশ্য এক। আবৃত্তি ও পাঠ এর মধ্যে আমার কাছে রূপ গত ও গঠন গত পার্থক্য থাকলেও উদ্দেশ্যের রূপাঞ্জলী অনেকটাই একই। আবৃত্তি করার জন্য কবিতা মুখস্ত থাকতে হবে এই শর্ত প্রধান ভাবেই উপনিত হয় আর পাঠে তার বালাই নেই। (যদিও আবৃত্তির বাধ্যগত মুখস্ত ব্যাপারটা আমার বোধগম্য নয়, সুন্দর পাঠ করেও আবৃত্তির পর্যায় কে আরো ছাপিয়ে যেতে পারে।) আমার মতে দুটোরই গুরুত্ব সমান।

কবিতা কেন আবৃত্তি করা প্রয়োজন -

কবিতা আবৃত্তি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন কারণে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সহায়ক। 

আবৃত্তি সাহিত্যিক শৈলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন কবির স্টাইল ও কৌশল শনাক্ত করা এবং তার বৈশিষ্ট্যগুলো প্রদর্শন করার জন্য আবৃত্তি একটি উপকারী মাধ্যম। এটি সাহিত্যকে আরও জীবন্ত ও গতিশীল করতে সাহায্য করবে।

কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে সাহিত্যিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। এর মাধ্যমে প্রাচীন কবিতা ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলি নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে পারে, যা সাহিত্যিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করবে ।

আবৃত্তি একটি শৈল্পিক অভিব্যক্তি। এটি শ্রোতাদের শিল্পের প্রতি আকর্ষিত করতে পারে এবং তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কবিতার রূপ, ভাষা, এবং ছন্দের মাধ্যমে সৃষ্টি করা আবৃত্তি একটি মৌলিক শিল্পকর্মে পরিণত হয়।

সামাজিক সচেতনতা এবং বার্তা, আবৃত্তির মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি সহজে আলোকিত করা যায়। কবিতার মাধ্যমে কবিরা সমাজের অসঙ্গতি, আনন্দ, বিষাদ এবং আশা প্রকাশ করেন, যা শ্রোতাদের মনে চিন্তা-ভাবনা সৃষ্টি করে।

সাংস্কৃতিক সংযোগ, কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি হয়। বিভিন্ন ভাষায় ও সংস্কৃতির কবিতাগুলোর আবৃত্তি শোনা শ্রোতাদের মধ্যে সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটায় এবং আন্তর্জাতিকতাবোধ তৈরি করে।

আবৃত্তি করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় - 

উচ্চারণ ও স্বর- আবৃত্তি করার সময় সঠিক উচ্চারণ এবং স্বরের প্রতীয়মানতা গুরুত্বপূর্ণ। বক্তার স্বরের উচুতা,গভীরতা এবং আবেগের প্রতিফলন আবৃত্তির মান বাড়ায়। শব্দের উচ্চারণ স্পষ্ট এবং সঠিক হওয়া আবৃত্তির মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটি শ্রোতার কাছে কবিতার ভাব স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়। সুন্দর, স্পষ্ট উচ্চারণ হতেই হবে। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি লাইনে শেষের শব্দটা মাইকে শোনা যাচ্ছে কিনা সেটা খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময়ে দেখা যায় যে লাইনের শেষের শব্দটি বলতে গিয়ে সেটা অস্পষ্ট হয়ে যায়, তাই মাইকে সেটা ধরতে পারেনা। বারবার এই সমস্যা হলে শুনতে ভালো লাগবে না। শব্দের সঠিক উচ্চারণ বজায় রাখা আবৃত্তির গুণগত মান বাড়ায়। উচ্চারণের ভুল হলে কবিতার অর্থও পাল্টে যেতে পারে। আঞ্চলিকতা পরিহার করিয়ে সাধারণ ভাষায় আবৃত্তি করা। 


অনুভূতির প্রকাশ- কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে কবির অনুভূতি ও ভাবনার সংক্ষেপণ ঘটে। এটি সভ্যতার আবেগ ও ভাবনাকে শ্রোতাদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়। আবৃত্তির সময় শব্দ, স্বর, এবং সুরের মাধ্যমে কবিতার গভীরতা ও আবেগ উদ্ভাসিত হয়, যা শ্রোতাদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।

কাব্যবন্ধ ও ভাব- কবিতার ভাব এবং কাব্যগত প্রকাশের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এটা নিশ্চিত করে যে শ্রোতার মধ্যে কবিতার মূল অসারতা পৌঁছায়। আবৃত্তিকারকে কবিতার ভাব ও আবেগকে সফলভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হতে হবে। আবেগের সঠিক প্রতিফলন আবৃত্তির গুণগত মান বাড়ায়। কবিতার বা পাঠ্যের গভীর অর্থ বুঝতে হবে। সাহিত্যকর্মের ভাব এবং তার পেছনের মানসিক স্বাস্থ্য অনুমান করতে হবে। 

ছন্দ ও তাল রক্ষা- কবিতার ছন্দ ও তাল বজায় রাখা জরুরি। এটি কবিতার আত্মাকে রক্ষা করে এবং শ্রোতার অভিজ্ঞতায় সৌন্দর্য যোগ করে। কবির ছন্দ ও তাল অনুযায়ী কথা বলুন। এটি কবিতা আরও জীবন্ত এবং স্বরবর্ণিত করে তোলে। কবিতার গতি এবং তাল অনুযায়ী পড়া। একটানা বা খুব দ্রুত পড়াতে শোনার আনন্দ কমে যায়। আবৃত্তির সময় শব্দের ঝংকার এবং সুরের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। এটি শ্রোতাদের কাছে আবেগ পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। 

শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ-  আবৃত্তিকারকে শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। এটি উপস্থাপনার শৈলী, স্বর ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে করা যেতে পারে। শ্রোতার যোগাযোগ, আবৃত্তিকার শ্রোতার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করছে সেই দিকে নজর রাখা প্রয়োজন। শ্রোতার অনুভূতির সাথে সমন্বয় বজায় রাখা আবৃত্তির জন্য অত্যন্ত জরুরি।

আবৃত্তি শিখতে হলে কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ -

কর্মশালায় অংশগ্রহণ- আবৃত্তির আদ্যোপান্ত জানতে ও আয়ত্তর জন্য বিভিন্ন কর্মশালায় অংশগ্রহণ করা গেলে তা সুবিধাজনক। স্থানীয় সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন। এটি আবৃত্তিতে অন্যদের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশনের সুযোগ দেবে এবং আপনাকে ব্যাকরণ ও উচ্চারণের উন্নতি করতে সাহায্য করবে। আবৃত্তি সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করুন। বিশেষজ্ঞদের থেকে শিখতে পারা এবং বিভিন্ন টেকনিক ও কৌশল আয়ত্তে আনতে ঘরোয়া প্রশিক্ষণ খুব সহায়ক। বন্ধু বা সহকর্মীদের সাথে আবৃত্তি অনুশীলন করুন। একে অপরের দায়িত্ব ভাগাভাগি করুন এবং পরস্পরের গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া প্রদান করুন। এটি বন্ধুত্ব ও ভালো সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্যও সহায়ক হতে পারে। ভিডিও কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার আবৃত্তি রেকর্ড করুন এবং পোস্ট করুন। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার কাজ প্রকাশ করলে শ্রোতা ও অন্যান্য মন্তব্যকারীদের কাছ থেকে মতামত পাওয়া যেতে পারে।

প্রদর্শনী দেখা-  প্রখ্যাত আবৃত্তিকারদের পরিবেশন লক্ষ্য করে তার কাছ থেকে বেশি কিছু শিখতে পারেন। প্র্যাকটিস করা, নিয়মিত অনুশীলন আবৃত্তি দক্ষতা উন্নত করতে সহায়তা করে । বিভিন্ন ধরনের আবৃত্তি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন এবং অন্যান্য শিল্পীদের কাজ থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে।

আবেগ, অভিব্যক্তি ও ভাষার গভীরতা-  ভাষার রূপ, রস ও গন্ধের প্রতিফলন আবৃত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার অঙ্গীকার ও অনুভূতি বোঝার জন্য আবৃত্তিকারকে ভাষার প্রতি গভীর দৃষ্টি দিতে হবে। আবৃত্তিতে কেবল শব্দগুলোর উচ্চারণ নয়, বরং এর সঙ্গে আবেগের প্রকাশও গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার কাহিনী ও অনুভূতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে চেষ্টা করুন। প্রতিটি লাইন কীভাবে অভিব্যক্ত করতে হবে সেটি বিবেচনা করুন। কবিতার আবেগ ও মানসিকতা ঠিকভাবে উপস্থাপন করা। আবৃত্তিকারকে কবিতার ভাব বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করতে হবে। কবিতার ভাষাগত গঠন এবং শব্দের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। অর্থ এবং আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে সঠিক শব্দ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যবহারিক অনুশীলন-  আবৃত্তি একটি বাচিক শিল্প এবং এটি নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে বিকশিত হয়। গবেষণা ও অভ্যাসের মাধ্যমে বিষয়বস্তু একাধিকভাবে পরিবেশন করতে সক্ষম হতে হয়। এগুলো হল আবৃত্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা একজন আবৃত্তিকারকে সাফল্যমণ্ডিত করে ও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। আবৃত্তির দক্ষতা বৃদ্ধি করতে নিয়মিতভাবে কবিতা বা আবৃত্তির রচনা অনুশীলন করুন। প্রতিদিন কিছু সময় এই কাজে ব্যয় করলে কণ্ঠস্বর, উন্নতি করা সম্ভব। নিজের আবৃত্তি রেকর্ড করুন এবং শুনুন। এতে আপনার দুর্বলতা এবং শক্তি চিহ্নিত করতে পারবেন। প্রতিদিন কিছু সময় ফোনেটিক্স বা শব্দের সঠিক উচ্চারণ শিখুন। অন্যদের সঙ্গে উচ্চারণের অনুশীলন করুন ।  অনুশীলন শো করে - বন্ধুবান্ধবের সামনে আপনার আবৃত্তির প্রর্দশনী করুন। এটি আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।

শ্বাস প্রশ্বাস ঠিক রাখতে হবে- কথার মাঝখানে যেন শ্বাস থেমে না যায় সেটা বিশেষভাবে খেয়াল করতে হবে। যদি শ্বাসের সমস্যা থাকে তাহলে সেটা থেকে বেরিয়ে আসুন। শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম থাকে সেগুলো করতে পারেন। শ্বাস ঠিক রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সংকোচন এড়াতে অথবা আওয়াজের স্পষ্টতা বাড়াতে শ্বাসপ্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দিতে হবে। সঠিক শ্বাসপ্রশ্বাসের কৌশল আবৃত্তির ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। মঞ্চে আত্মবিশ্বাসী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি রাখতে হবে। শ্রোতাদের সঙ্গে চোখের যোগাযোগ এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।মঞ্চে আত্মবিশ্বাসী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি রাখতে হবে। শ্রোতাদের সঙ্গে চোখের যোগাযোগ এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। 

কথা বলার গতি ঠিক রাখতে হবে- যেভাবে বুঝিয়ে কথা বলতে হয়, সেভাবেই স্বাভাবিক গতিতে কবিতাটা পড়তে হবে । খুব তাড়াতাড়ি লাইনের পর লাইন বললে যেমন হবে না তেমন খুব বেশি ধীর গতিতে বললেও হবে না। 

আত্মবিশ্বাসী ও গলার জোর থাকতে হবে-  যদি খুব আস্তে আস্তে কবিতা পড়লে ব্যাপারটা মিনমিনে বলে মনে হবে আবার বেশি জোরে বললে চিৎকারের মত শোনাবে। তাই সেদিকে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে একমাত্র অভ্যাস করেই সেটা আয়ত্ব করতে হবে। এখানে গলার জোর মানেই কিন্তু এই নয় যে খুব জোরে জোরে চিৎকারের মত কবিতা বলতে হবে। আবৃত্তির সময় আত্মবিশ্বাসী থাকুন। যত বেশি আত্মবিশ্বাসী হবেন, তত বেশি আপনার কণ্ঠস্বর ও ভঙ্গি প্রভাব ফেলবে। ইতিবাচক চিন্তা আপনার পারফরম্যান্সকে উন্নত করতে সাহায্য করবে। আপনার শরীর ভাষা ও ভঙ্গিমা দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং আকর্ষণীয় করা উচিত।

 কবিতার অর্থ এবং কবিতার সুর বুঝতে হবে- কোন জায়গায় কিরকম আবেগ নিয়ে বলতে হবে সেটা বুঝতে হবে। কবিতাটা বারবার পড়ে সেটা কোন অনুভুতি নিয়ে লেখা সেটা বুঝতে হবে। সুর মানে তো গানের সুর নয়, এমন ভাবে বলতে হবে যেখানে আপনার কণ্ঠে সেই শক্তি, আবেগ ও শান্তি ফুটে ওঠে। কবিতাকে বারবার পড়তে হয় ।কবিতার সাথে বসবাস করতে হয়। কবিতার চিত্রকল্পগুলিকে মানসচক্ষে দেখতে হয় । চরিত্র খুঁজে বের করতে হবে। নারী চরিত্র থাকলে নারীদের পড়া উত্তম। পুরুষ চরিত্র থাকলে পুরুষদের পড়া উত্তম। কবিতার চরিত্রে নিজেকে কল্পনায় দেখা। কবিতাটি কোন পটভূমিতে লেখা হয়েছে, তা জানা। কবিতার পুরো বক্তব্যকে বুঝে নিতে হবে। বুঝতে হবে কবিতাকে কীভাবে উপস্থাপন করলে দর্শক-শ্রোতা গ্রহণ করবে। কবিতার কোথায় কোথায় কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আনা সম্ভব। কবিতার কোথায় কোথায় থামলে অধিক অর্থ প্রকাশ পাবে। কোন লাইনে কোন আবেগ আছে। কোথায় কোন রস প্রয়োগ করতে হবে। স্বরাঘাত, মডুলেশন, ইমফ্যাসিস, ইমোশন, স্ক্যানিং, কালার-টেকচার, পজ, মির প্রভৃতি বুঝতে হবে।

বিভিন্ন কবিতা বা রচনা নির্বাচন-  বিভিন্ন ধরনের কবিতা, গদ্য, ও অন্যান্য সাহিত্যকর্ম আবৃত্তির জন্য নির্বাচন করুন। বিভিন্ন ধরণের রচনা পড়া আপনার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বাড়াবে এবং নতুন চ্যালেঞ্জ দেবে।

কবিতা আবৃত্তির প্রধান তিনটি ক্ষেত্র- 

সাহিত্যিক ক্ষেত্র-  এ ক্ষেত্রে কবিতার ভাব, ভাষা এবং সাহিত্যের গভীরতা সম্পর্কে জানা এবং তা শ্রোতার সামনে প্রকাশ করা হয়। কবিতার কাহিনী, চরিত্র এবং সংবেদনশীলতা বোঝা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। 

বাচিক ক্ষেত্র-  এই ক্ষেত্রে আবৃত্তিকারদের বাচিক কৌশল, মানসিকতা এবং ভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক উচ্চারণ, ছন্দ ও তাল বজায় রাখা, এবং আবেগের সঠিক প্রকাশ এই ক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য দিক। 

শ্রোতা বা দর্শক ক্ষেত্র-  আবৃত্তি একটি সংলাপধর্মী শিল্প, যেখানে শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া ও মনোযোগ বিশেষ গুরুত্ব পায়। শ্রোতাদের মনের অনুভূতি ও আগ্রহকে অভ্যাসের মাধ্যমে বুঝতে পারা আবৃত্তিকারদের জন্য অপরিহার্য। 

এই তিনটি ক্ষেত্র মিলিয়ে কবিতা আবৃত্তির একটি সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা শ্রোতার জন্য একটি অতিকৈশরী অভিজ্ঞতা তৈরি করে। গান এবং নাচের জন্য যেমন চর্চা বা সাধনা করতে হয় আবৃত্তির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটি প্রয়োজন। বরঞ্চ আবৃত্তি শিল্পীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যদের তুলনায় আরও কঠিন বলা চলে। 

কয়েকটি ধাপে আবৃত্তি প্রস্ততি নেয়া যেতে পারে :-

 কবিতা নির্বাচন - প্রথমে একটি কবিতা নির্বাচন করুন। এটি আপনার পছন্দের, স্বীকৃত কবি বা নতুন রচনার একটি কবিতা হতে পারে।

কবিতা বুঝতে পারা - কবিতাটি ভালোভাবে পড়ুন এবং এর বিষয়বস্তু, ভাব, ও আবেগ বুঝুন। কবিতার প্রতীক, অর্থ এবং লেখকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিজের ধারণা তৈরি করুন।

মুখস্থ করা- কবিতাটি কয়েকবার উচ্চারণ করে মুখস্থ করার চেষ্টা করুন। মুখস্থ করার সময় প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ ও আবেগকে গুরুত্ব দিতে হবে ।

আবেগ ও অভিব্যক্তি- প্রতিটি লাইনের আবেগ অনুভব করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী নিজের অভিব্যক্তি তৈরি করতে হবে। কবিতার বিষয়বস্তু অনুযায়ী আপনি কীভাবে আলাদা আলাদা আবেগ প্রকাশ করবেন সেটি চিন্তা করুন। শরীরের ভাষা, চোখের যোগাযোগ এবং অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করতে হবে। এটি কাহিনীর সঙ্গে আরও বাস্তবতা এনে দেয় এবং শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করে।

উপস্থাপনার ধারণা- সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও, বা মঞ্চে আবৃত্তির জন্য একটি সৃজনশীল উপস্থাপন পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। 

প্র্যাকটিস করতে হবে- লিখিত কবিতা বার বার অনুশীলন করতে হবে। প্রতিবার উচ্চারণ, ছন্দ এবং আবেগের প্রকাশে মনোযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনে বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সামনে অনুশীলন করতে হবে। 

প্রস্তুতি - মঞ্চে আবৃত্তি দেওয়ার আগে মানসিক প্রস্তুতি নিতে। আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে এবং অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। 

উপস্থাপন করতে হবে- সবশেষে, কবিতাটি উপস্থাপন করতে হবে। আপনার গ্রামের বা শহরের কোনো সাহিত্যিক অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা যেতে পারে। শ্রোতার প্রতি গভীর মনোযোগ দিতে  হবে। 

এই ধাপগুলো অনুসরণ করে একজন দক্ষ আবৃত্তিকার হিসেবে প্রস্তুতি নেয়া যেতে পারে। আবৃত্তির দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নিয়মিত অনুশীলন ও অভিজ্ঞতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পঠন ও আবৃত্তি অর্থ-

পঠন এবং আবৃত্তি দুটি আলাদা কিন্তু সম্পর্কিত কার্যক্রম, যাদের প্রত্যেকটির নিজস্ব অর্থ এবং প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পঠন শব্দটি সাধারণত বোধগম্যভাবে লেখা বা মুদ্রিত শব্দ, বাক্য, বা পাঠ্যবস্তু বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এর মাধ্যমে একজন পাঠক একটি লেখা থেকে তথ্য অর্জন করে এবং তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করেন। পঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে পঠনের সময় লেখা সামগ্রী বুঝতে পারা। পঠন শুধুমাত্র পড়া নয়, বরং বিষয়ের প্রতি গভীর আকর্ষণ ও শিখনের একটি প্রক্রিয়া। পাঠের মাধ্যমে নতুন ধারণা বা উদ্দেশ্য সৃষ্টি করা। পড়ার কাজ, অধ্যয়ন; পাঠ, আবৃত্তি" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ।  

আবৃত্তি শব্দটি বিশেষভাবে কবিতা, গানের লাইন অথবা সাহিত্যকর্মের মৌখিক উপস্থাপনকে বোঝায়। আবৃত্তির মাধ্যমে কবিতা বা সাহিত্যকর্মের শব্দ এবং সুরে মনের ভাব প্রকাশ করা হয়।  আবৃত্তির সময় আবেগ, সুর, এবং ভঙ্গি ব্যবহার করা হয়, যা শ্রোতাদের মনে একটি গভীর প্রভাব ফেলে।  এর মাধ্যমে শ্রোতা কবিতা বা সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তু এবং আবেগ অনুভব করে।  আবৃত্তির অর্থও হল "কবিতা, গান বা সাহিত্যকে উচ্চস্বরে পড়া বা উপস্থাপন" যা শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এটি সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্যিক বিশেষণের অংশ । পঠন কার্যক্রম লেখাভিত্তিক, যেখানে বাক্যের অর্থ বুঝতে পাঠক মনোযোগী হয়, আর আবৃত্তি হল সেই লেখাকে মৌখিকভাবে প্রকাশ করার শিল্প, যা শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং আবেগকে স্পর্শ করে।

নান্দনিক প্রযোজনা ও নাটকের আবৃত্তি

নান্দনিক প্রযোজনা এবং নাটকের আবৃত্তি একটি সৃজনশীল প্রশিক্ষণ ও শিল্পের মাধ্যমে সাহিত্যমূলক ব্যবস্থাপনা তুলে ধরে। এই প্রক্রিয়ায় কবিতা ও নাটককে উচ্চারণের মাধ্যমে বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা প্রকাশের নান্দনিকতা বাড়ায়। নান্দনিক প্রযোজনা শুধুমাত্র একটি শিল্পের পরিবেশন নয়, বরং এটি একটি ভাবনা, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ। এর মূল উদ্দেশ্য হল দর্শক, শ্রোতা বা দর্শনার্থীদের কাছে একটি নির্দিষ্ট অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা পৌঁছে দেওয়া। নান্দনিক বিষয়বস্তু, কাহিনী এবং ভাষার মধ্যে জমিন তৈরি করা। পাঠ্য বা নাটকের আবেগ প্রকাশের জন্য যেভাবে উচ্চারণ ও শরীরী ভাষাকে ব্যবহার করা হয়। শ্রোতাদের মনোযোগ ও আগ্রহ আকর্ষণ করার লক্ষ্য।  

নাটকের আবৃত্তি মূলত মূল কাহিনীর বা কবিতার নাটকীয় উপস্থাপনা, যা প্রচলিত শব্দ ও উচ্চারণের বাহিত হয়। এর ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত, যা আবৃত্তিকারকে নাট্যাভিনয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করতে সহায়তা করে। নাটকের আবৃত্তিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হল: পাঠ্যের গভীরতা, নাটকের পাঠ্যের অর্থ এবং অনুভূতি সম্পূর্ণরূপে বোঝা এবং তা উপস্থাপন করা।  অভিনেতার ভূমিকা, আবৃত্তিকার হিসেবে অভিনয়শিল্পীর বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ এবং শারীরিক অভিব্যক্তির সঙ্গে কল্পনা শক্তি ব্যবহার করা।  শ্রোতার প্রতিক্রিয়া, শ্রোতাদের অনুভূতি, ইচ্ছা এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হওয়া, যাতে আবৃত্তি আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। 

নান্দনিক প্রযোজনা ও নাটকের আবৃত্তি একটি গভীর শিল্প, যা শুধুমাত্র একটি গদ্য বা কবিতা প্রচার করে না, বরং শ্রোতাদের মনে প্রভাব ফেলে। এটি শিল্পীর অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং বোধশক্তির একটি সংমিশ্রণ, যা সৃজনশীলতার নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় আবৃত্তিকার এবং দর্শকদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সংযোগ গড়ে ওঠে, যা সঙ্গীত, নাটক এবং সাহিত্যের সমাহার ঘটায়।

 কবিদের চোখে আবৃত্তি কেমন হওয়া উচিত

কবিদের চোখে আবৃত্তি একটি বিশেষ শিল্প, যা শুধুমাত্র শব্দের উচ্চারণ নয়, বরং অনুভূতির, ভাবনার এবং শৈল্পিক মানসিকতার সমন্বয়। বিভিন্ন কবিদের মতে, আবৃত্তির উপযুক্ততা নিম্নলিখিত দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়:-

ভাবের গভীরতা, কবিরা বিশ্বাস করেন যে আবৃত্তির সময় পাঠ্যের গভীরতা ও অর্থ প্রকাশ করার জন্য আবৃত্তিকারকে গভীর আবেগ এবং বোঝাপড়া নিয়ে কাজ করতে হবে। তাদের মতে, কবিতার প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের ভেতরে যে অনুভূতি বিদ্যমান, তা শ্রোতার কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা জরুরি।

 শব্ধের উপস্থাপন, শব্দের সঠিক উচ্চারণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ শোনানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কবিদের চিন্তায়, শব্দের মাধুর্য এবং সুর একটি আবৃত্তিকে আরও চিত্তাকর্ষক করে তোলে।

 শরীরী ভাষা, শরীরী ভাষার ব্যবহার আবৃত্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কবিরা মনে করেন যে, অঙ্গভঙ্গি, চোখের যোগাযোগ এবং বাক্যের আঙ্গিক সহ আবৃত্তিকারীর উপস্থিতি দৃশ্যমান হতে হবে, যাতে শ্রোতারা কবিতার সঙ্গে আরও সংযুক্ত হতে পারে।

 সুর ও ছন্দ, কবিতার নিজস্ব সুর ও ছন্দ বজায় রাখা আবৃত্তির একটি মৌলিক অংশ। কবিরা মনে করেন যে, সঠিক সুরের মাধ্যমে আবৃত্তি আরও প্রভাবশালী ও হৃদয়গ্রাহী হয়।

 শ্রোতাদের প্রতি মনোযোগ, কবিদের দৃষ্টিতে আবৃত্তিকারদের জন্য শ্রোতাদের প্রতি মনোযোগ দেয়া জরুরি। শ্রোতাদের মনোভাব এবং প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে আবৃত্তিকারকে নিজের উপস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে।

আবেগের প্রকাশ, আবৃত্তির সময় আবেগের সঠিক প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ. কবিরা মনে করেন, কবিতায় যে আবেগ আছে তা শ্রোতাদের হৃদয়ে পৌঁছাতে হবে। আবৃত্তিকারকে সেই আবেগের স্পষ্ট উদাহরণ দিতে হবে।

কবিদের চোখে আবৃত্তি একটি শিল্প যা শুধুমাত্র পাঠ্যের সংশ্লেষ নয় বরং কবির ভাব ও অনুভূতির একটি প্রতিফলন। একটি সফল আবৃত্তি তার সৃজনশীলতা, আন্তরিকতা এবং শ্রোতার সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর ক্ষেত্র তৈরি করে। এই সকল দিকের সমন্বয়ে আবৃত্তি হয়ে ওঠে একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা শ্রোতার মনে প্রভাব ফেলে। 

সব কবিতাই কি আবৃত্তি করা যায়

সব কবিতা আবৃত্তি করা সম্ভব নয়, কারণ কবিতার আবৃত্তির জন্য কিছু নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা ও গুণমান থাকতে হয়। আবৃত্তির ক্ষেত্রে যে কবিতাগুলো বিশেষভাবে উপযোগী, সেগুলো সাধারণত আবেগপূর্ণ, অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ । আবৃত্তির জন্য উপযুক্ত কবিতায় গভীর আবেগ এবং অনুভূতি থাকতে হবে, যা শ্রোতাদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে। 

কবিতার ছন্দ ও শব্দের ব্যবহার আবৃত্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভাল ছন্দ ও সুরেলা শব্দের সংমিশ্রণ আবৃত্তিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। সমাজ, প্রাকৃতিক জগত, প্রেম, অথবা মানব জীবনের চ্যালেঞ্জের মতো বিষয়বস্তুগুলি সাধারণত আবৃত্তির জন্য বেশি নির্বাচিত হয়।  কিছু বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কবিতাগুলি আছে যেগুলি সারা দেশে প্রতিবাদ করেছেন, যেমন কাজী নজরুল ইসলামের "বিদ্রোহী" এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা। এই কবিতাগুলো আবৃত্তির জন্য খুবই উপযুক্ত। অন্যদিকে, কিছু কবিতা, যেমন জটিল বা বিমূর্ত ভাষায় লেখা, আবৃত্তির জন্য ততটা উপযুক্ত নাও হতে পারে। এই কারণে সব কবিতা আবৃত্তি করা সম্ভব বিষয়টি নির্ভর করে কবিতার ধরন, ভাষা এবং গুণমানের উপর। 

বাংলাদেশের আবৃত্তি চর্চার পটভূমি 

বাংলাদেশে আবৃত্তির বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করা যেতে পারে, যেমন-

সাংগঠনিক দিক, বাংলাদেশে আবৃত্তির সংগঠনগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ২০০/৩০০-এর অধিক আবৃত্তি সংগঠন রয়েছে, যার অভিভাবক সংগঠন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। এই সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের মাধ্যমে আবৃত্তির চর্চা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শিল্পটিকে একটি সুশৃঙ্খল কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসছে । 

 সাংস্কৃতিক প্রভাব, আবৃত্তি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। কবিতা আবৃত্তি ও সংস্কৃতির চর্চা মানুষের মানবিকতা ও সামাজিকতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে আবৃত্তি করার চেয়ে অনলাইন যোগাযোগকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন, যা একটি চ্যালেঞ্জিং দিক

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দৃশ্যে আবৃত্তি নতুন মাত্রা পায়। স্বাধীনতা আন্দোলন, জাতীয় চেতনা এবং সামাজিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে আবৃত্তি উঠে আসে। ১৯৮৩ সালে হাসান আরিফ স্বরিত প্রতিষ্ঠা করেন আবৃত্তি সংগঠন, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন আবৃত্তি কেন্দ্র এবং কর্মশালার মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

 সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনা, বাংলাদেশের আবৃত্তিতে সৃজনশীলতার নতুন ধারণা প্রবাহিত হচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের কবিতা, গান, নাটক এবং সৃজনশীল লেখার সঙ্গে আবৃত্তি যুক্ত হচ্ছে। এটি আবৃত্তিকে একটি বহুমাত্রিক শিল্পে পরিণত করছে এবং এর প্রসার ঘটাচ্ছে।

 বাংলাদেশের আবৃত্তিচর্চার ধারা এক কথায় ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমির ওপর নির্ভরশীল। এটি শুধুমাত্র শিল্পের একটি মাধ্যম নয় বরং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন যা ভাষা, ইতিহাস, ও সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। আবৃত্তির শক্তিশালী ধারা আজকের দিনে আরও সম্প্রসারিত ও বিকশিত হচ্ছে, যা ভাষা প্রেমীদের জন্য একটি সৌন্দর্য ও সৃষ্টির ক্ষেত্র নিয়ে এসেছে।

শিল্প হিসেবে আবৃত্তির ভবিষ্যৎ

আবৃত্তি, একটি শিল্প হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে এবং এটি আগামীতে আরও একটি বিকশিত পেশাদার শিল্পে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন শিল্পী এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠনের মতামত অনুযায়ী, আবৃত্তির ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল এবং উদ্ভাবনমূলক।  আবৃত্তি শিল্পটি বাংলাদেশে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে, যেখানে এটি পেশাদার শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। আবৃত্তি যে শুধু একটি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, তা নয়, বরং এটি একটি গম্ভীর পেশাগত দিকও রয়েছে। এই শিল্পের জন্য যথেষ্ট সুযোগ এবং সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে ।

সামষ্টিক উদ্যোগ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আবৃত্তি শিল্পের প্রসার ঘটাতে চেষ্টা করছে। তারা দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি এবং শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে, যা আবৃত্তির শিল্প কে আরও প্রতিনিধিত্বময় করে তুলবে

নতুন প্রযুক্তির প্রভাব, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে আবৃত্তির শিল্পও সৃজনশীলতার নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে পারবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে এই শিল্পের প্রসার আরও বেড়ে যাচ্ছে, যা শিল্পীদের জন্য আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে এবং তাদের কাজকে বিভিন্ন দর্শকের সামনে নিয়ে আসছে। এই পরিবর্তনগুলি আবৃত্তির ভবিষ্যৎকে আরো গ্রহণযোগ্য এবং উত্তরোত্তর বিকশিত করে তুলবে, আবৃত্তির শিল্পের ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল এবং সৃজনশীল, যেখানে এটি শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রতিনিধিত্ব করবেনা, বরং একটি পেশাদার ও সার্বজনীন শিল্পের রূপে গঠন করতে সক্ষম হবে। শিল্পীদের উদ্যোগ, সমাজের সমর্থন এবং প্রযুক্তির সহায়তা এই শিল্পের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আবৃত্তি ও অভিনয়

আবৃত্তি ও অভিনয় সমগোত্রীয় শিল্প হলেও এ দুয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অভিনেতা অভিনয়গুণে চরিত্রকে বাস্তবানুগ করে উপস্থাপন করে। আবৃত্তিকার আবৃত্তিগুণে শ্রোতাদের কবির কল্পনাশ্রয়ী জগতে পৌঁছে দেয়। অভিনয়ের হাসি-কান্না, মান-অভিমান, লম্ফ-ঝম্প, নাচ-গান কোনোটিরই স্থান নেই আবৃত্তিতে। অভিনয়ে প্রায় মুখস্থ বিদ্যার অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাস থাকে, কিন্তু আবৃত্তিতে আত্মস্থ করা বিষয়ের কিংবা মুখস্থ বিদ্যার নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ ঘটে। অভিনেতা-অভিনেত্রীকে পরমুখাপেক্ষী হয়ে অর্থাৎ প্রমোটারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে সংলাপ আউড়ে যেতে হয়। আলো, মঞ্চসজ্জা, পোশাক সর্বস্বতা, অতিরিক্ত আবহ ইত্যাদি মিলিয়ে অভিনয়। এর প্রায় সংলাপই স্বাভাবিক কণ্ঠের নয়। আবৃত্তিতে সবই স্বাভাবিক, কৃত্রিম নয়। আবৃত্তিতে নায়ক কিংবা নায়িকা সুলভ চেহারার প্রয়োজন নেই। অভিনয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী যিনি নির্দেশকের অনুকরণে যতটা পটু, তিনি ততটা সফল। অভিনয় মঞ্চ সমষ্টিগত, প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখাপেক্ষী। কিন্তু আবৃত্তি মঞ্চের সম্রাট একা আবৃত্তিকারই। যে কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী তার পারফরম্যান্স খারাপ করতে পারেন সহযোগী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যর্থতায়। কিন্তু আবৃত্তিকারের তেমন কোনো ভয় নেই, যদি তিনি নিজে কোনো ভুল না করেন। কবিতায় বিবৃত বক্তব্য উপলব্ধি করতে না পারা, প্রমিত উচ্চারণ না করা, ছন্দের শাসন উপেক্ষা করা এবং সর্বোপরি স্বেচ্ছাচারিতাই আবৃত্তিকারদের ভয়।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'আবৃত্তি আর অভিনয় দুটো স্বতন্ত্র শিল্প। কিন্তু দেখছি অনেকেই দুটোকেই অভিন্ন মনে করেন। তাই গলা কাঁপিয়ে এবং হাত-পা নেড়ে আস্ফালন করাকে তাঁরা আবৃত্তি বলে চালিয়ে দেন। আবৃত্তি বাচনিক শিল্প, অভিনয় আনুষ্ঠানিক শিল্প। আকারে সহধর্মিতা থাকলেও প্রকারভেদ রয়েছে দুটোর মধ্যে।'

অভিনয়ে দেখার বিষয়টি প্রধান। আর আবৃত্তিতে শোনার বিষয়টি প্রধান। অভিনয়ে শরীরের মুভমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আবৃত্তিতে স্বরের মুভমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ। আর স্বরের মুভমেন্ট শরীরের মুভমেন্টের চেয়েও কঠিন।

 পালাবদলে অতীত আর বর্তমানের আবৃত্তি’র আঙ্গিক

বাঙালি আবৃত্তির আঙ্গিক অতীতে ও বর্তমানে অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। এই পরিবর্তনগুলি বিভিন্ন দিক থেকে লক্ষণীয়, যেমন প্রযুক্তির প্রভাব, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, এবং শিল্পের স্বরূপ।

অতীতের আবৃত্তিতে সাধারণত একটি নিখুঁত এবং প্রথাগত শৈলী ছিল, যেখানে শিল্পীরা কবিতাকে একটি নির্দিষ্ট স্টাইলে পরিবেশন করতেন। সত্তর থেকে আশির দশকের আবৃত্তির আঙ্গিক ছিল অনেকটা মৌলিক এবং কম্পোজিশনাল, যেখানে কণ্ঠস্বরের সুনির্দিষ্ট ব্যবহার ছিল। তৎকালীন সময়ের আবৃত্তিকাররা কাঠামোবদ্ধ ও রূঢ় আঙ্গিক অনুসরণ করতেন। 

বর্তমানের আবৃত্তি অনেক বহুমুখী ও উদ্ভাবনী। এখানে কাহিনী বলার এক আধুনিক পদ্ধতি রয়েছে, যা আবৃত্তিকে বেশি আকর্ষণীয় ও প্রভাবশালী করে তোলে। আজকাল আবৃত্তিকাররা মৌলিক শৈলীর বাইরে গিয়ে অনেক নতুন ভঙ্গি ও ধারনা প্রয়োগ করছেন, যেমন ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রভাবের সঙ্গে আবৃত্তি মিলিয়ে পরিবেশন করছেন।

সাম্প্রতিককালে প্রযুক্তির সাহায্যে আবৃত্তির প্রচার ও প্রসারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক মিডিয়া এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহার করে শিল্পীরা তাদের কাজকে আরও সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছেন। আবৃত্তির ধরন এখন কেবল শ্রোতার সম্মুখেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভিডিও এবং অডিও মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পৌঁছাচ্ছে যা অতীতে ছিল না। 

বর্তমান আবৃত্তি অনেকগুলি নান্দনিক উপাদান ব্যবহার করে, যেখানে আবেগ, অভিব্যক্তি, ও চিন্তার সৃজনশীলতা একত্রিত হয়ে একটি নতুন শিল্প তৈরির চেষ্টা করছে। এই সময়ে আবৃত্তিকারদের মধ্যে পেশাদারিত্বেরও উন্মেষ ঘটেছে, যা শিল্পের মান বৃদ্ধি করেছে। আবৃত্তির আঙ্গিক অতীত থেকে বর্তমানের দিকে উল্লেখযোগ্যভাবে পাল্টেছে। আধুনিক ছন্দ, প্রযুক্তি, এবং সৃজনশীলতার প্রবাহ আবৃত্তিকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে, যা অতীতের কাঠামোবদ্ধ শৈলীর থেকে অনেকটাই ভিন্ন।

আবৃত্তি শিখতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন

আবৃত্তি শেখার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কতটা অপরিহার্য, সেই বিষয়টি একজন শিক্ষার্থী বা আবৃত্তিকার জন্য বিভিন্নভাবে দেখা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আবৃত্তির মৌলিক কৌশল, কণ্ঠস্বরের সঠিক ব্যবহার, উচ্চারণ, আবেগ প্রকাশ এবং কবিতার পাট-ব্যাখ্যা শেখার জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে এটি অপরিহার্য নয়।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আপনাকে আবৃত্তির সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বুঝতে সাহায্য করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা আবৃত্তির ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী।

প্রতিষ্ঠানের বাইরে শেখার সময় পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত প্রশিক্ষণ পাওয়া কঠিন হতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপ পাওয়া যায়, যা শেখার প্রক্রিয়াকে সহজ করে।

আবৃত্তি সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ অন্য শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করে, যা একে অপরকে উৎসাহিত করে। 

যাইহোক, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া আবৃত্তি শেখারও অনেক উপায় রয়েছে:-

অনলাইন কোর্স ও ভিডিও,ইউটিউব ও বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে আবৃত্তির উপর কোর্স এবং ভিডিও রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন কৌশল এবং ধারণা শেখার সুযোগ পাওয়া যায়।

আবৃত্তি শেখার জন্য বিভিন্ন বই এবং নির্দেশিকা ব্যবহার করা যেতে পারে। বইয়ে মৌলিক ধারণা এবং কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা থাকে। 

স্থানীয় সংস্কৃতিক কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হয়, যেখানে অংশগ্রহণ করে আপনার দক্ষতা উন্নত করা সম্ভব।

নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি করে এবং আত্মমূল্যায়ন করে দক্ষতা অর্জন করা যায়। এইভাবে আপনার উন্নতির জন্য নিজেই লক্ষ্য স্থির করতে পারেন।

সুতরাং, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আবৃত্তির ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে, তবে এটি একমাত্র পথ নয়। অন্যান্য অনেক উপায়ের মাধ্যমে নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

পেশাদার আবৃত্তিকার হতে হবে কি

আবৃত্তি করার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, এবং এটি একটি শিল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবৃত্তি শিল্পী নিম্নতম শ্রোতা থেকে গড়ে তোলা আবেগ, চিন্তা ও অনুভূতিগুলি প্রকাশ করে। এটি কবিতা, গল্প, বা প্রবন্ধের মাধ্যমে শিল্পীর ভাবনা ও সৃজনশীলতা তুলে ধরে।

আবৃত্তির মাধ্যমে নিজেদের ভাবনা ও অনুভূতিগুলিকে সঠিকভাবে যোগাযোগে আনা যায়। এটি বাকপটুতা, আত্মবিশ্বাস এবং শ্রোতার কাছে বক্তব্য উপস্থাপনের ব্যাপারে দক্ষতা প্রদান করে।

আবৃত্তি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এটি সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে স্থান পেয়ে থাকে এবং সমাজের ইতিহাস ও কৃষ্টিকে পরিচিত করার মাধ্যমে সমাজকে সমৃদ্ধ করে। 

আবৃত্তিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং জনসমক্ষে কথা বলার দক্ষতা উন্নত হয়। এটি মানসিক উন্নয়ন ঘটায় এবং একজনকে আরও অভিব্যক্তিশীল হতে সহায়তা করে।

সবাই পেশাদার আবৃত্তিকার হতে পারে না, তবে এটি বলা যাবে যে অনেক মানুষ এতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে উন্নতি করতে পারেন। পেশাদার আবৃত্তিকার হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট দক্ষতা ও গুণাবলী প্রয়োজন:-

একজন পেশাদার আবৃত্তিকার প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন ধরনের কবিতা ও বক্তব্যের উপর অভ্যাস করতে হবে। আবৃত্তি করার জন্য সঠিক উচ্চারণ, লয়, অনুপ্রেরণা ও ভাব প্রকাশের দক্ষতা থাকতে হয়। পেশাদার আবৃত্তিকারদের জন্য শরীরভাষা, চোখের সংযোগ এবং অন্যান্য অঙ্গভঙ্গির ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ।  পেশাদার আবৃত্তিকারদের মঞ্চে প্রকাশ পাওয়ার সক্ষমতা এবং শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষমতা থাকতে হয়। 

একথা বলা যায় যে, আবৃত্তি করা একটি শখ বা মুক্ত সময়ের আয়োজন হতে পারে, এবং কিছু ক্ষেত্রে পেশাদার হিসেবে কাজ করার জন্য কেউ প্রস্তুত হতে পারে। তবে, একজন সফল পেশাদার আবৃত্তিকার হতে চাইলে কার্যকর প্রশিক্ষণ, অধ্যবসায় এবং মনোযোগের প্রয়োজন।

 সামাজিক আবৃত্তি পদ্ধতি 

সামাজিক আবৃত্তি পদ্ধতি একটি সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত প্রচেষ্টা যা সৃজনশীলতা ও পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের বিভিন্ন দিক, সমস্যা এবং সৌন্দর্য প্রকাশ করা। সামাজিক আবৃত্তি পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়বস্তু, যেমন মানবতা, সমতা, সংস্কৃতি, ও ঐতিহ্য প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা এবং আদান-প্রদান করা হয়।

সামাজিক আবৃত্তি পদ্ধতিতে বিভিন্ন সমাজের সদস্যরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এতে সবাই তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারে এবং পরস্পরের সাথে আলোচনা করতে পারে।

এই পদ্ধতি মানুষের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। কাহিনীগুলি, কবিতা, এবং অন্যান্য উপস্থাপনার মাধ্যমে সংবেদনশীল বিষয়গুলোকে তুলে ধরা হয়, যা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায়।

সামাজিক আবৃত্তির মাধ্যমে সমাজের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়। এটি মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও ঐতিহ্যের 

বিপ্লবী বা প্রতিবাদী আবৃত্তি ক্ষেত্র

বিপ্লবী বা প্রতিবাদী আবৃত্তি একটি সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন যা সামাজিক পরিবর্তন এবং স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তোলে। এই ধরনের আবৃত্তি সাধারণত সরকারের শোষণ, সামাজিক অবিচার ও অসাম্যতা, যুদ্ধবিরোধী মনোভাব, এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর মাধ্যমে কবিরা তাদের চিন্তা ও অনুভূতিগুলি প্রকাশ করেন এবং বৃহত্তর জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করেন।

বিপ্লবী আবৃত্তির উৎপত্তি সাধারণত রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন সময়ে, যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময়, এই ধরনের আবৃত্তি মানুষের মনে আশার বীজ বপনের কাজ করেছে।

কবিরা সাধারণ মানুষের বিপদের কাহিনী তুলে ধরেন এবং শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। স্বাধীনতা,অধিকার ও মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম ও স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা এই আবৃত্তির মূল বিষয়। মানবতার পক্ষে আওয়াজ, যুদ্ধ, ধর্ম, জাতিগত সংঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মানবতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ। 

বিপ্লবী আবৃত্তি সামাজিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করে এবং মুহূর্তগুলোকে চিহ্নিত করে। এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে প্রভাব ফেলে এবং শান্তি ও সমতার জন্য সংগ্রামে জ্বালানির কাজ করে।

বর্তমানে, সামাজিক মিডিয়া ও প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতিবাদী আবৃত্তি নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। কবিরা তাদের কাজগুলো সরাসরি সংসদের মত জায়গায় তুলে ধরতে পারেন, যেখানে জনগণের প্রতিক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। এই সব দিক থেকেই বিপ্লবী বা প্রতিবাদী আবৃত্তি উল্লেখযোগ্য এবং সমসাময়িক ধ্যান-ধারণার নির্দেশক।

আবৃত্তি সৌন্দর্য লালনে আবৃত্তিকার ও কবিদের ভূমিকা 

বাংলাদেশে আবৃত্তিকার ও কবিরা আবৃত্তি সৌন্দর্য লালনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁরা তাঁদের শিল্পের মাধ্যমে বাংলা কবিতার সৌন্দর্যকে জীবন্ত করে তুলেছেন এবং আবৃত্তির মাধ্যমে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রোতার আগ্রহ বৃদ্ধি করেছেন। 

জনপ্রিয় আবৃত্তিকার শিমুল মুস্তফা, মাহিদুল ইসলাম মাহি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আবৃত্তিকার,অসাধারণ অভিনয় এবং আবৃত্তি সক্ষমতার জন্য পরিচিত। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর আবৃত্তি শ্রোতাদের মন জয় করেছে। আরো প্রমুখ। 

শারমিন লাকী, তিনি একজন প্রখ্যাত আবৃত্তিকার এবং আলোচক। তাঁর আবৃত্তিতে আবেগ এবং অভিব্যক্তির এক চমৎকার সমন্বয় দেখা যায়, যা শ্রোতাদের কাছে কবিতাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর- তিনি একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন আবৃত্তিকার হিসেবে ও বাংলা সাহিত্যের গুণীজন হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী- তিনি বাংলা কবিতার আবৃত্তি চর্চাতে বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং তাঁর আবৃত্তির মাধ্যমে কবিতার সৌন্দর্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছেন। কাজী সব্যসাচী-  কবি এবং আবৃত্তিকার হিসেবে তাঁর কাজ ও অবদান বাংলা সংস্কৃতির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিমুল মুস্তাফা-কবিতা এবং আবৃত্তির সম্পর্ক অনেকটা মা-মাসির মতো। কবিতা জন্ম দেন কবি, তিনি মা। আর আবৃত্তিকাররা কবিতার মাসি অন্তত। জনক না হলেও স্নেহের জায়গাটা, প্রেমের জায়গাটা, আন্তরিকতার জায়গাটা, লালনের জায়গাটা একজন আবৃত্তিকারের কিন্তু কোনো অংশেই কম নয়। কবিতা মানুষের বোধের জায়গা তৈরি করে, মানুষকে উপলব্ধি করার জায়গা তৈরি করে। আমি কবিতাকে এভাবেই ধারণ করি। 

রবিশঙ্কর মৈত্রী - নিত্যসত্যকে বিশ্বাস ও প্রেম দিয়ে উচ্চারণই আবৃত্তি। রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শকে আমরা শব্দের মাধ্যমে বোধের কাছে নিয়ে যাই এবং অখণ্ড বোধকে উচ্চারণে সজীব করে তুললেই আবৃত্তি হয়। অতএব আবৃত্তি শুধু কণ্ঠ দিয়ে নয়, আমরা আবৃত্তি করি পঞ্চভূত ও পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে। আবৃত্তি করার জন্য প্রথমত লাগে প্রাণ। প্রাণ মানে বায়ু। বায়ু গ্রহণ করার পর যদি বাক্প্রত্যঙ্গকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে সেই বায়ু ঠিক ঠিকভাবে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তাতেই আবৃত্তি প্রাণময় হয়। বায়ু বা বাতাস এবং আবৃত্তি একে অন্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। বায়ুর সঙ্গে আরও আছে ক্ষিতি-অপ-তেজ এবং ব্যোম। আবৃত্তির গভীরে যাবার আগে জানতে হবে পঞ্চমহাভূত।

অনেক কবিই কবিতাকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে আবৃত্তির ভূমিকাকে কমবেশি স্বীকার করেছেন । বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার তো আবৃত্তিকে শিল্পই বলেছেন যেমন কবি মৃদুল দাসগুপ্ত আবৃত্তিকে শিল্প বলে মানেন নি ।

শ্রীমতী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়-কোনো পাঠের সামগ্রিক রূপকে কণ্ঠস্বরে যথাযথ প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রমিত উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রেখে বিষয়ের ধারণকৃত অনুভূতি, আবেগ, ভাব, গতি, বিরাম, ছন্দ ইত্যাদির সমন্বিত ও ব্যঞ্জনার প্রকাশই আবৃত্তি পাঠ করার শিল্প।

আবৃত্তি সম্রাট কাজী সব্যসাচী ইসলাম | সৈয়দ আল জাবের আহমেদ- আবৃত্তি মুগ্ধমধুর শিল্প। শ্রুতি স্নিগ্ধ নান্দনিক প্রায়োগিক শিল্প। কবিতা যদি চাঁদ হয় তাহলে আবৃত্তি চাঁদের জোছনা। কবিতা ও আবৃত্তি মানুষের মন ও মনন ছুঁয়ে যায়, স্পর্শ করে। বোধের উন্মেষ ঘটায়, উত্তেজিত করে আবেগ, বিনোদিত হয় চিত্ত, উদ্বেলিত হয় হৃদয়।

তারিক সালাহউদ্দিন মাহমুদ - আবহ সংগীত আবৃত্তির জন্যে উত্তম কথা। তবে আবহ সংগীতকে মানসম্পন্ন হওয়া দরকার। আবৃত্তি একটি সূক্ষ্ম স্পর্শকাতর শিল্প। সে কারণে আবহ সংগীত তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়া চাই। মানসম্পন্ন মিউজিক আবৃত্তিকে অধিকতর স্ফুট করবে। আবৃত্তিতে মিউজিকের ব্যবহার, এর চমৎকারিত্ব বাড়বে। কিন্তু কথা আছে। মনে রাখতে হবে, নতুন ধারার আবৃত্তি স্পর্শকাতর এবং ধ্রুপদী শিল্প। সে কারণে মিউজিক এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া দরকার

প্রখ্যাত কবিদের মাঝে কাজী নজরুল ইসলাম , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাগুলি আবৃত্তির মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার ফলে তাঁর সৃষ্টি আরও প্রসারিত হয়েছে। তাঁদের কবিতার সৌন্দর্য আবৃত্তিতে বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। জীবনানন্দের কবিতার মাখানো শব্দ এবং অনুভূতি আবৃত্তিতে বিশিষ্টভাবে প্রকাশ করা হয়, যা শ্রোতাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। সেখ সিরাজুদ্দিন- তাঁর কবিতার সংবেদনশীলতা এবং বাস্তবতার প্রতিফলন আবৃত্তির মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যায়। আরো প্রমুখ আছেন ।

‘কবি হিসেবে আমার কবিতাসৃষ্টি অনেকটাই আবৃত্তিনির্ভর’, সেটা রবীন্দ্রাথই বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি কিন্তু কবিতারচনার সময় আবৃত্তি করতে করতে লিখি, এমনকি যখন গদ্যরচনা ভালো করে লিখবো বলে মনে করি, এই গদ্য লিখতে লিখতেও আবৃত্তি করি। কারণ ধ্বনিসঙ্গতি ঠিক হল কিনা তার একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে কান।’ তাঁর এই উপলব্ধি এতোটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে, শেষ পর্যন্ত তা আবৃত্তিকারকেই কবিতার নান্দনিক উপস্থাপনায় রসদ জুগিয়েছে।

সারাংশে, কবিতা আবৃত্তি শুধুমাত্র সাহিত্যিক সৃজনশীলতা নয়, বরং এটি মানব সম্পর্ক, সামাজিক সচেতনতা এবং সাংস্কৃতিক মানসিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর মাধ্যমে আমরা মুক্তভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে পারি এবং সমাজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারি।

আবৃত্তির এর পৃথক ভাষাব্যবস্থা আছে। প্রকাশ-প্রকরণে অন্যান্য শিল্প থেকে এর সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নিজস্ব চলার রীতি আছে আবৃত্তির। অবশ্যই স্বয়ম্ভু শিল্প। বস্তুবাদী আবৃত্তির ভিত্তি—দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী নন্দনতত্ত্ব। অপরদিকে ভাববাদী আবৃত্তির ভিত্তি কালকৈবল্যবাদ, যার সঙ্গে বাস্তবের যোগ নেই। আবেগ আবৃত্তির প্রাণ। এক অর্থে আবেগ আবৃত্তির ভাষা নির্মাণ করে। অনুভব, উপলব্ধি, ভাব, অনুভূতি ইত্যাদি নিস্ক্রিয়-ইন্ট্রোভার্ট। আবেগ হলো সক্রিয়-এক্সট্রোভার্ট। কবিতা নিবিড় পাঠের বিষয় । নিভৃতে পাঠের বিষয় । তার বেঁচে থাকার জন্য আবৃত্তির আশ্রয় জরুরী হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় । কবিতাকে বেঁচে থাকতে হবে তার নিজের শক্তিতে । তার গ্রাফিক উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে । আগেই উল্লেখ করা হয়েছে আবৃত্তিকারেরা কেবল মুষ্টিমেয় কিছু কবির জনপ্রিয় কবিতাই আবৃত্তি করেন । বহু বহু কবি, বলা যেতে পারে অধিকাংশ কবি, বিশেষ করে নতুন যাঁরা লিখছেন তাঁরা আবৃত্তিকারদের কন্ঠ পান না । ফলে কবিতাকে জনপ্রিয় হতে হলে কবির নিজের উদ্যোগে তা পাঠকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে ।

পবিত্র কোরআনের সুরা মুযযাম্মিলে রয়েছে- “ও রাত্তিলিল কুরানা তারতিলা” অর্থাৎ তোমরা তারতিলের সাথে কোরআন পাঠ করো। এখানে তারতিল মানে আবৃত্তি বোঝানো হয়েছে। স্মরণাতীত কাল থেকে,বোধ করি কবিতা সৃষ্টির সময় থেকে আবৃত্তি সমাদৃত হয়ে আসছে। বৈদিক ঋষিরা বেদমন্ত্র আবৃত্তি করতেন। সে আবৃত্তিতে নির্দিষ্ট ছন্দ ছিল,স্বরের নির্দিষ্ট ওঠাপড়া ছিল। পবিত্র কোরআনেও তারতিল অর্থাৎ আবৃত্তির মতো থেমে থেমে কোরানকে পড়তে বলা হয়েছে । বাংলা ভাষায় আবৃত্তির নবতর প্রকাশ ঘটে বিশ শতকের গোড়ার দিকে।এতকাল বাংলায় আবৃত্তি বলতে যা বোঝানো হত,তা হল পাঁচালী,পুঁথি,ধর্মগ্রন্থ বা রূপকথা ইত্যাদির সুরেলা পাঠ।

কবি একটি কবিতা যখন লেখেন এক জন্মযযন্ত্রণা অনুভব করেন তিনি । একজন আবৃত্তিকার বারবার আবৃত্তির মাধ্যমে কবির সেই কবিতার জন্মকালীন অনুভবের মুহূর্তে পৌঁছে যান, যেন একই প্রসূতিবেদনায় ক্লিষ্ট ও হৃষ্ট । কবি নিজে কিন্তু তখন অন্য কবিতা নিয়ে ব্যস্ত । অন্য কবিতা জন্ম দেবার অনুভবে ভাবিত । কিন্তু আবৃত্তিকারই কবিতাকে বারবার আবিষ্কার করেন তার পুনরুদ্ধারের মধ্যে দিয়ে । এই অর্থে তিনিও একজন স্রষ্টা । সুতরাং শিল্পী ।

মুখে মুখে কবিতা বলার এই যে ধারা এটা নতুন নয় । যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে । সেই বেদের কাল থেকে । যুগান্তরের এই যে সাধনা, তার পরম্পরা, তাকে শিল্প বলে মেনে নিতে সঙ্কোচ হবার কথা নয় । কবিতাকে আবৃত্তিতে রূপদানের জন্য কবিতার নিগূঢ় অর্থ বের করতে পারঙ্গম হতে হয়। আর অনুশীলন ও অধ্যবসায় ছাড়া এই পারঙ্গমতা অর্জন অসম্ভব। আবৃত্তি এমন একটা শিল্প যাতে সামান্যতম খুঁতও গ্রহণযোগ্য নয়। একটা সাদা কাপড়ে সামান্য কালো দাগ যেমন চোখ এড়াতে পারে না তেমনি অতি সামান্য ভুলও একটা সুন্দর আবৃত্তিকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে যথেষ্ট। সেটি স্বরের প্রয়োগ হোক, উচ্চারণ হোক, বোধ হোক বা ভাব হোক সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই বলা যায় আবৃত্তি হলো শিল্পীর তুলিতে আঁকা একটি নিখুঁত চিত্রশিল্প। যেখানে থাকবে না রঙের যথেচ্ছ ব্যবহার আবার যা নয় ধূসর রঙহীন। 

প্রথমে আবৃত্তিকেই হতে হবে হৃদয়স্পর্শী। হৃদয়কে জয় করতে হয় হৃদয়-নিংড়ানো সত্যস্বর দিয়েই। যা কিছু সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী হয়ে ওঠে, সে বিষয়ক কোনো দ্বিধাগ্রস্ত প্রশ্ন তখন আর কোনো দুর্মুখই উচ্চারণ করবে না।

জয় হোক আবৃত্তির-জয় হোক কাব্যের।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন

Ads

Ads