💜 আত্মজৈবনিক - আশরাফ আল যায়েদ

আত্মজৈবনিক - আশরাফ আল যায়েদ

১. শৈশব : পিতৃহীনতার পাঠ

“শুরুতেই হারিয়ে যাওয়া মানেই শূন্যতা নয়,

শূন্যতাই হয়তো জন্ম দেয় দৃঢ়তাকে।”

না, আমার কোনো আক্ষেপ নেই।

চন্দ্রমল্লিকার বাগান থেকে যিনি প্রথম আমাকে কোলে নিয়েছিলেন, তিনি আর বেশিদিন থাকেননি। সাদা আর কালোর পার্থক্য না বুঝিয়েই, তিনি সাদা মার্কিন কাপড় জড়িয়ে চলে গেলেন অনন্তলোকে। তখন আমার বয়স মাত্র সাড়ে তিন।

মা প্রতিদিন রাতে ঘুম পাড়ানোর সময় বলতেন—

“বাবা ফিরে আসবে, ঘুমিয়ে পড়।”

বাবাহীন ঘুমই তখন আমার জীবনের প্রথম শিক্ষা।

২. কৈশোর : মানিয়ে নেওয়ার শুরু

“যৌবন মানেই নিজেকে চিনে নেওয়া,

কখনো ফুলের হাতে, কখনো আঘাতের তীরের কাছে।”

প্রতিবেশি আর আত্মীয়ের কথার তীর ক্রমাগত বিদ্ধ

করতো।কৈশোরে শরীর বদলাতে শুরু করলো। বগলে লোম গজাল, গালের লোম মোটা হতে হতে আম্মা বললেন, “এখন থেকে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হবে।”

সত্যিই, মানিয়ে নেওয়া শিখেই বড় হয়েছি।

প্রথম প্রণয় ছিল অন্ধ। ডুমুর ফুল হাতে নিয়ে চেয়েছিলাম যাকে, সে আগেই গোলাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সেদিন শিখলাম—প্রেম আর প্রণয় এক নয়।

৩. জ্ঞান ও দর্শনের খোঁজ

“মানুষ চোখে দেখে যতটুকু, তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে অদৃশ্যে।”

আত্মার শান্তির তৃষ্ণায় আমি খুঁজেছি নানা পথ—রূহ, পঞ্চভূত, ধ্যান, যোগ, সাধনা আর ঈশ্বরপ্রেম। বুঝেছি, মানুষ অদৃশ্যে বিশ্বাস করতেই ভালোবাসে। আধিপত্যের লালসা আছে সবার মধ্যে, এমনকি ঈশ্বরও এর ব্যতিক্রম নন।

তখন মনে হলো—ধর্ম জন্মগত নয়, বরং দর্শনগত।

৪. নেশার অতল গহ্বর

“মদ আর নেশা কখনো শান্তি আনে না,

তবু শান্তির খোঁজেই ডুব দিই তার অন্ধকারে।”

শিক্ষার উচ্চ শিখরে উঠতে উঠতে আমি স্পর্শ করেছি অন্ধকারকেও।

দেশি-বিদেশি মদ, ছিলিম, আফিম, মেটাফেটামিন, ক্লোনাজেপাম, ডায়েথিলামাইড—সবই পাড়ি দিয়েছি। ভাত আর নামতো না পাকস্থলীতে। টানা এক বছর দই আর লুচিতে বেঁচেছিলাম।

৫. পরিবার : বিচ্ছেদ আর মৃত্যু

“মৃত্যু সবসময় হঠাৎ আসে,

কিন্তু তার শূন্যতা থাকে চিরকাল।”

বোনের বিবাহবিচ্ছেদ আমাকে আঘাত করেছিল গভীরভাবে। কিন্তু তারও বেশি অন্ধকার নেমেছিল যেদিন আমার নাড়ির যোগে বাঁধা প্রাণ, আমার প্রথম স্বরের শ্রোতা, আমার আম্মা—আমারই বাম বাহুতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।

আমি কাঁদিনি। অশ্রু জমে আছে শুভ্র তুষার হয়ে হৃদয়ের গভীরে। ভাবী—যদি সত্যিই পরকাল থাকে, তবে সেই তুষার গলিয়ে মাকে লোনা জলে স্নান করাবো। কারণ মা কোনোদিন সমুদ্র দেখেননি।

৬. বিশ্বাস ও প্রেমের ভাঙন

“বিশ্বাস ভাঙলে কেবল প্রেম নয়,

মানুষও ভেঙে যায় ভেতর থেকে।”

ছাব্বিশ বছর বয়সে এসে প্রেম আর বিশ্বাস আমার কাছে নিছক প্রতারণা মনে হলো।

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কারারুদ্ধ, আর তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী অন্যের প্রেমে নিমগ্ন। মাত্র হপ্তাখানেকের মাথায় ভাঙন।

পৈতৃক সম্পত্তির জন্য মামলা হলো। ভাঙা হাত নিয়ে এজলাস, সেরেস্তা, নকলখানায় ঘুরেছি। দেখেছি—সবখানে ঘুষ ও অনিয়মের জয়জয়কার। চোখ বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা লেডি জাস্টিসের পাল্লা আদৌ কি সমান থাকে?

হায়, আমার আব্বার জমি! যমুনার হাঙ্গর তা গ্রাস করে নিয়েছে।

৭. প্রেমের পুনর্জন্ম ও বিসর্জন

“প্রেম যতবার জন্মায়, ততবার মরে যায়,

তবু মানুষ প্রেমকেই খোঁজে অনবরত।”

আবার প্রেমে পড়েছিলাম নারীর সাথে নারীর সাদৃশ্য খুঁজতে গিয়ে।

তবু শিখলাম—ঈশ্বরের প্রেম ছাড়া সব মিথ্যা।

দুর্ঘটনার পর একদিন গিয়েছিলাম যৌনপল্লিতে। সেখানে এক নারীর চোখে যে মমতা দেখেছিলাম, তা সেই প্রেমিকার চোখে পাইনি। তখনই বুঝলাম ভুলতে হবে—মানুষ চাইলে সব ভুলে যেতে পারে। আমিও তারে ভুলতে  পেরেছি।

৮. বর্তমান জীবন : ভিটে ও প্রকৃতি

“প্রকৃতির ছোট্ট প্রাণীর কান্নায়ও

অন্তর্লীন হয়ে থাকে মানবতার প্রশ্ন।”

আমি এখন জামালপুরের কলেজ রোডের দোচালা ভিটায় থাকি।

এখানে দোয়েল, বলবুলি, ঝি-ঝিঁ, জোনাকি গান গায়। রাতের তারারা খসে পড়ে। তবু আমরা পাড়ার অসুস্থ কুকুরটির খোঁজ নিই না। অথচ সব প্রাণের উৎস তো একই।

আগুনকে ভয় পেলে আগুন ব্যবহার করা যায় না। আমিতো মোম; প্রিয়জনের দ্যুতিতে গলে নিঃশেষ হতে চাই।

৯. দর্শন ও বোধ

“যাকে ছাড়া বাঁচা যাবে না ভেবেছিলাম,

আজ তাকে ছাড়াই দিব্যি আছি।”

জীবন আমাকে শিখিয়েছে—যাকে একসময় ছাড়া বাঁচা অসম্ভব মনে হয়েছিল, সেটাই একসময় দূরে চলে গেছে। অথচ আমি দিব্যি বেঁচে আছি।

বুঝেছি—সৃষ্টিকর্তা চান না কেউ তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কিছুকে বেশি কামনা করুক।

সময়ের সাথে যেমন কেওড়া, বৈলাম, সোনালু ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।

তার সঙ্গে আমিও।

১০. সমাপ্তি : মৃত্যু ও ভ্রম

“স্থিরতা কেবল মৃত্যুতেই,

বাকি সবই চলমান ভ্রম।”

আমার কোনো দুঃখ নেই।

দাড়ি যত বড় হয়েছে, মাথার চুল তত ঝরে গেছে। কেউ আমাকে রবীন্দ্রনাথ বলবে না, আবার ধার্মিক মোল্লাও নয়। আমি জানি—আমার মা ও আমার সঙ্গিনীর মাসিকের রং অভিন্ন। এক ফুলের মর্ম জানতে হাজারো ফুলের বোঁটা গুটিয়ে ফেলেছি।

আমি মহাপাপী!

তবু শান্তির খোঁজে আছি।

জানি—স্থিরতা কেবল মৃত্যুতেই।

এই দুনিয়ার সবই ভ্রম।